ছোট লালবাড়ির ভোট, কল্লোলিনী তিলোত্তমার জন্য প্রতিশ্রুতির বান বইছে, এমনিতে কলকাতা বছর দশেক আগেও এত সুন্দর ছিল না৷ বড় ফ্লাইওভার, রাস্তা ঘাট ঝকঝকে, রেলিংয়ে নীল সাদা রং, আলো জ্বলছে ঝিকির মিকির৷ গান বাজছে, তুমি কেবলই ছবি? ট্র্যাফিকের মোড়ে মোড়ে। সবটাই কি এমন?
না, তাও নয়। খাল চুরি হয়ে গিয়েছে এ মহানগরে৷ এখনও বর্ষা এলে ভেনিস ভেনিস লাগে, লাগে তো। এখনও কল্লোলিনীর ফুটপাথে শীতে কুঁকড়ে ঘুমোয় অনেক মানুষ৷ মহানগরের শ্রমের যোগানদার। সেই চালচিত্রে ভোট ভোট, আবার ভোট। কিন্তু অনেক কিছু বদলে গিয়েছে, ৫০/৬০ নয়, মাত্র বছর দশেক ঘুমিয়ে, ঘুম থেকে উঠে, রিপ ভ্যান উইঙ্কল এই ভোট ছবিকে স্বপ্নই মনে করতো। আসুন, সেই বদলে যাওয়া ছবি নিয়ে কিছু আলোচনা করি।
প্রথম বদল প্রার্থী তালিকায়, দশ কেন? গত বিধানসভার নির্বাচনেও বহু বহু কুচুবুলুদের আমরা আসরে দেখেছি, বামেদের তেমন নয়, তৃণমূল, বিজেপিতে ভরপুর তারা, যারা রাজনীতির র এর সঙ্গেও জড়িত ছিল না কোনওদিন৷ ছাত্র রাজনীতি ইত্যাদি তো ছেড়েই দিন, মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ বলতে, মাচায় উঠে বন্ধুরা… বলা ছাড়া আর কোনও সম্পর্কও ছিল না৷ কেউ কেউ রাজনৈতিক দলের প্রসাদপুষ্ট ছিলেন বটে, কিন্তু তা ছিল রাজনীতি বিযুক্ত। তাঁরা প্রার্থী হয়ে গেলেন, তাঁদের প্রার্থী করা হল, যো জিত গয়া ও সিকন্দর, যাঁরা যেতেননি তাঁরা কপ্পুরের মত উবে গেলেন, দলত্যাগ করলেন, মন চল নিজ নিকেতনে, তাঁরা মেক আপ ডায়ালগে ফিরে গেলেন। আমরা তো ভেবেছিলাম, এবার লাল বাড়ির ভোটে সেই অঞ্জনা, কাঞ্চনা, রিমঝিম, লামা, অনিন্দ্য পুলকরা থাকবেন, আলো করে থাকবেন। তাঁরা কোথায়? প্রার্থী নন, বেশ তো, প্রচারে? নেই। বিজেপির প্রার্থী তালিকায় একজনও নেই, নেই তৃণমূলের তালিকাতেও। মানে রাজনীতি, রাজনীতিতে ফিরছে। তার সুর দলের অন্যতম নেতার কথাতেও৷ সাংসদের মিটিংয়ে না থাকার জন্য মিমি আর নুসরতকে শোকজ করা হল। মানে, ভাই আপনি রাজনীতিতে এসেছেন, রাজনীতিটা করুন, আপনার কুচুবুলু সত্তা তো আছেই, কিন্তু এটাও একটা সিরিয়াস কাজ, সেটা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করিয়ে দিলেন, প্রার্থী তালিকাও সেই কথাই বলছে। কংগ্রেসের তালিকায় একজনও নেই, নেই কারণ ওমুখো কেই বা যাবে? প্রথম বদল প্রার্থিতালিকায়, যাঁরা দাঁড়িয়েছেন, তাঁরা পাড়ায়, রাস্তায় মিছিলে, মিটিং এ থাকেন, রাজনৈতিক বিতর্কে থাকেন, বোঝেন, অন্তত বোঝার চেষ্টা করেন। বিরোধী থাকার সময়ে লাঠি খান, জেলে যান, স্টুডিও টু নমিনেশন ডে নন। আমি রাজনীতির বাইরে, আমি তৃণমূলের পক্ষে কথা বলি, বিজেপির বিরুদ্ধে বলিনা, এক অন্য রাজনৈতিক সংস্কৃতি, গুলিয়ে দেবার কথাবার্তা তাঁরা বলেন না, আমি বিজেপি তো কী? নির্বাচন প্রচারের মধ্যেই একটু নেচে আসি, ওহ লাভলি, এরকম নন, এঁরা ক্ষমতায় থাকলেও রাজনীতি করবেন, ক্ষমতার বাইরে থাকলেও রাজনীতিই করবেন, উবে যাবেন না, ভালো বদল, পালা বদল।
আরও পড়ুন: চতুর্থ স্তম্ভ : ধান কাটি, কাটি ধান, ধান কাটি
দ্বিতীয় বদল, শোনা গেল তৃণমূল দলের শীর্ষ নেতার মুখ থেকে, ভোট দিতে দিন, মানুষকে অধিকার প্রয়োগ করতে দিন, কেউ বাড়াবাড়ি করলে দল তাঁকে বহিস্কার করবে, প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে৷ বললেন আবার সেই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। আপনি বলতেই পারেন, জয় অনিবার্য, দু একটা আসনে গোলমাল, অতি উৎসাহীদের ছাপ্পা ভোট আদতে দলের ছবি বিগড়ে দেবে৷ সারা দেশে তা নিয়ে আলোচনা হবে৷ সে সব মাথায় রেখেই এ কথা বলা। বেশ তো, এ রকম অবস্থা তো সিপিএমেরও ছিল৷ আমরা এই সাবধানবাণী তাদের গলায় শুনিনি। এটা বদল, ভালো বদল৷ রীতি পালটাক৷ মানুষ ভোট দিন অবাধে৷ এটা তো কাম্য৷ তাই ভোটের আগে শাসক দলের গলায় এরকম আশ্বাস শুনতে ভাল লাগে৷ যে অগণতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে দেশ জোড়া লড়াই, তা জোর পায়, ভরসা পায়।
আর কী বদল? তৃতীয় বদল, বিজেপির প্রচারে। গতবারের প্রচার মনে আছে? ওফ, সে এক ব্যাপার। কোটি কোটি টাকা খরচ কেবল নয়, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, তাবড় তাবড় বিজেপি নেতাদের আনাগোনাই শুধু নয়, চারিদিকে রব বিজেপি এল, বিজেপি এল। যেন রঘু ডাকাত আসছে। মিডিয়া দেখে মনে হচ্ছিল, নেহাত কপালজোরে যদি তৃণমূল জিতে যায়, তাহলেই ঢের। আব্বাস সাব্বাস মাঠে, সেলিম সাহাবের সঙ্গে কোলাকুলি করে, ঠিক না বেঠিক? ঠিক ঠিক ঠিক। ছায়া মন্ত্রিসভা তৈরি হচ্ছে বিজেপির হেস্টিংস সভাঘরে, সূর্যকান্ত মিশ্র বলছেন, নির্বাচনের পরেও তৃণমূলকে সমর্থন করব না, করব না, করব না। তিন সত্যি, তো সমর্থন করার জন্য একজনও যে থাকবে না, সেটা তাঁর জানা ছিল না। মান্নান, অধীর, প্রদীপদাদের অন্য ছক৷ তালেগোলে আবার যুক্তফ্রন্ট, ক্ষমতার ভাগেদারি। এবং নো ভোট টু বিজেপি, দেওয়ালে দেওয়ালে লাল ফালি পোস্টার, তাদের মিছিল আর সভা। কোথায় কী? গড়াগাছা সংসদের সঙ্গে রিয়েল মাদ্রিদের ফুটবল ম্যাচ, একশ টা সভা, স্ট্রিট কর্নার মিটিং, পদযাত্রার ৯০ টা তৃণমূলের, ১০ টা বিরোধীদের, এটা কোনও খেলা হল?
চতুর্থ বদল স্লোগান৷ গত নির্বাচনে পপুলার শ্লোগান, খেলা হবে, শ্লোগান ছিল তৃণমূলের, মুখে মুখে ঘুরেছে, না এবার তেমন কোনও স্লোগান নেই। এক্কেবারে নেই বলবো না, সিপিএম এর স্লোগানটা ইন্টারেস্টিং, কলকাতার স্টিয়ারিং বামদিকে ঘুরিয়ে দিন, স্লোগান তো ইন্টারেস্টিং, কিন্তু তা মানুষের কাছে নিয়ে যাবেটা কে? বাম কোথায়? একটা সিওর সিট? কোনটা? এবং এই কিছু দিন আগে, হা হা হা হা, দুয়ারে সরকার? কি হাসি, কি তাচ্ছিল্য, কি ব্যঙ্গ। আজ সেই বামেরা উঠোনে পাঠশালার কথা বলছেন, তা ৩৪ বছরে কোন উঠোনে পাঠশালা গেছে? সিপিএম এর তৃণমূলিকরণ শুরু হয়েছে, এ প্রক্রিয়া চলবে।
পঞ্চম বদল জোটে৷ গতবার তিন পক্ষ ছিল, তৃণমূল, বিজেপি আর সংযুক্ত মোর্চা। এবার? ভাই ভাই, ঠাঁই ঠাঁই। জোট গিয়েছে গঙ্গাযাত্রায়। অর্থাৎ আব্বাস সাব্বাসকে বাদ দিলে এবার চতুষ্কোণীয় লড়াই, তৃণমূল, বিজেপি, বাম আর কংগ্রেস, সুবিধে? অবশ্যই তৃণমূলের।
আরও পড়ুন: চতুর্থ স্তম্ভ: সংসদ…সংসদীয় গণতন্ত্র
আলোচনার ষষ্ঠ এবং শেষ বদল হল, ভোটের ফলাফল। গত ১০/১৫/২০ বছরে এমন নিশ্চিত জয়কে সামনে রেখে তৃণমূল মাঠে নামেনি, মোট আসন ১৪৪, তৃণমূল খুউউউউব খারাপ করলে ১২০, আর ভাল করলে ১৩৬/১৩৮ টা আসন, গণতন্ত্রের পক্ষে ভাল? আমরা বলব, না। এরকম নিরঙ্কুষ সংখ্যাগরিষ্ঠতা, শাসকের মাথা ঘুরিয়ে দেয়। ওরা ৩৫, আমরা ২৩৫। আমাদের মনে আছে, কারখানা হবে, হবে হবেই, আমাদের মনে আছে, মনে আছে, আমাদের ক্যামেরা মাইক বুম হাত দিয়ে সরিয়ে দেওয়ার কথা৷ সেই আত্মম্ভরিতা আমাদের মনে আছে। কিন্তু অবাধ নির্বাচনে কোনও দল যদি ১৪৪ এ ১৩৬/১৩৮ টা আসন পায়, তাহলে আমরা তা নিয়ে বলার কে? আমরা কেবল আপ্তবাক্যটাই মনে করাচ্ছি, গণতন্ত্রে এক সবল বিরোধীর দরকার আছে। কে বলেছেন? অনেকেই বলেছেন। বারবার বলেছেন, এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই হাফ ডজন বদল নিয়ে মহানগরে ভোট এল, ভোট শান্তিতে মিটুক৷
মহানগরে শীত নেমেছে৷ কে না জানে এ কল্লোলিনী আরও অনেক বেশি তিলোত্তমা হয় এই শীতে৷ এখনও কুয়াশা গায়ে মেখে মন্থরগতি ট্রাম চলে যায়, মোড়ের চায়ের দোকানে উনুনের ধোঁয়া, গ্যাস স্টোভে গরম চা, বান্ডিল করা খবরের কাগজ উড়ে আসে খবর নিয়ে, এ মহানগরে আসে ভুটিয়ারা গরম পোষাক নিয়ে, দক্ষিণ থেকে আসে জয়নগরের মোয়া, এখনও আসে সার্কাস, ট্রাপিজের খেলা, জোকার আর মেনকা গান্ধীর বারণে সিংহ ছাড়া রিং মাস্টার, সে এখন কাকাতুয়ার খেলা দেখায়, ছাপা হয় এখনও অজস্র লিটল ম্যাগাজিন, বিদ্রোহ আর বিপ্লবের গান নিয়ে হাজির হয় যাদবপুর, প্রেসিডেন্সি, আমাদের বইমেলায়, পাশেই থাকে বিরিয়ানি, চপ, রোল আর ঘুগনি, বিপ্লবের জ্বালানি হিসেবে। গান গায় অনুপম রায় গিটার নিয়ে, শ্রীজাত সই বেলায়। ফেস্টিভ্যাল, ফেস্টিভ্যাল। কত শত ফেস্টিভ্যাল এই শীতবেলায়। কমলালেবু নিয়ে, ডিমসেদ্ধ নিয়ে কেউ কেউ চলে যায় চিড়িয়াখানায়, রানীর সঙ্গে নতুন সেলফি জোন হয়েছে, এই খবর পেয়ে। নাহুম বিকোত সেই কবে, এখন কত শত ব্রান্ডেড, নাব্রান্ডেড কেক থরে থরে বাঁশদ্রোণী থেকে চিৎপুর। সান্তাক্লজ পোশাক পরে আসে বস্তির কালুয়া, দিনে ৩০০ টাকার কড়ারে। বড়লোকেদের আদুরে বাচ্চাদের মন যোগাতে নাচে, হাত নাড়ায়, পেটে তার বড্ড খিদে। জিঙ্গল বেল, জিঙ্গল বেল। সেন্ট পলসের ঘন্টা বাজে, জাহাজঘাটায় ভোঁ বাজবে, ততদিনে পেয়ে যাব আমাদের নতুন মহানাগরিক, আগামী পাঁচ বছরে তাঁরই হাতে থাকবে কলকাতা তিলোত্তমা। যেখানে ঘুপচি অন্ধকার, যেখানে বসতি দিন আনি মানুষের, তাদের ভালো হোক, কেবল বহিরঙ্গে নয়, অন্তরঙ্গে সুন্দর হয়ে উঠুক কলকাতা, আমাদের কলকাতা।